রমজানের আহবান

রমজানের কল্যাণ লাভ মুমিনের পরম সৌভাগ্যের বিষয়। তাই রমজান মাস আসার আগেই মুমিন-মুসলিমগণ এর ফজিলত হাসিলের জন্য নিজেকে তৈরি করে থাকেন। আর আল্লাহর কাছে বলতে থাকে, হে আল্লাহ, আপনি আমাদের রমজান পর্যন্ত নেক হায়াত দান করুন। বেশি বেশি নেক আমল করার তাওফিক দিন। যেন রমজান আমার জীবনে সমস্ত অপূর্ণতার গ্লানি মুছে দিয়ে ঈমানের পূর্ণতায় ভরিয়ে দেয়। রমজান শেষে মুমিনের পেরেশানি আরো বেড়ে যায়। তাই তারা বলতে থাকেন, হে আল্লাহ, রমজানে আমরা যা আমল করেছি তা আপনি কবুল করে নিন।’

রমজানের আহবান
মহানবী সা: রমজানের দুই মাস আগে থেকেই রমজান প্রাপ্তির জন্য দোয়া করতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসের বরকত দান করুন। আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস নম্বর ৩৮১৫) রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে মহানবী সা: শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘নবী করিম সা: (প্রায়) পুরো শাবান মাসই নফল রোজা পালন করতেন। (মুসলিম, হাদিস নম্বর- ২৭৭৯)
তবে রমজানের দু-এক দিন আগে থেকেই মহানবী সা: রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। তবে কেউ আগে থেকে রোজা রাখায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার বিষয়টি আলাদা। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত এক হাদিসে মহানবী সা: বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন রমজানের এক দিন বা দুই দিন আগে রোজা না রাখে। তবে আগে থেকে এ দিনে রোজা রাখার কেউ অভ্যস্ত হয়ে গেলে সে ওই দিনও রোজা রাখতে পারে।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর- ১৮১৫)
রমজান রহমত, বরকময় ও নাজাতের মাস। পুণ্য হাসিলে এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আর কিছু হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘রমজান মাস এমন একটি মাস, যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে। যে কিতাবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই হিদায়াত ও সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিত। যা সঠিক পথ দেখায়, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই মাস পাবে, সে যেন এ মাসে অবশ্যই রোজা রাখে।’ (সূরা আল বাকারা, আয়াত-১৮৫)
নবী করিম সা: ইরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাস এলেই জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানদের বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়।’ (মুসলিম, হাদিস নম্বর ১০৭৯) হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত এক হাদিসে মহানবী সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসে রাতে ও দিনে জাহান্নামিদের মুক্তি দিয়ে থাকেন। এভাবে রমজানের প্রতি দিন ও রাতে মুসলমানের দোয়া কবুল করা হয়।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নম্বর ৬৬৪) আল্লাহর কোনো বান্দা যদি নেক উদ্দেশ্যকে অন্তরে ধারণ করে আর সঠিক নিয়তের সাথে উত্তম পন্থায় কর্ম সম্পাদন করে, আল্লাহ তার সেই আমলকে কখনো বরবাদ করে দেন না। বরং সেটি সাদরে গ্রহণ করে তার যথাযথ পুরস্কার দিয়ে থাকেন। তাকে সেই কাজ করার ধৈর্য, সততা ও একনিষ্ঠতা দান করে থাকেন।
সামনে এমন এক মাস, যে মাসের একটি রাতকে হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। যে মাসের যে কোনো পুণ্য ও কল্যাণময় কাজের পুরস্কার বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ মাসের নফল ইবাদত অন্য মাসের ফরজ ইবাদতের সমান। আর একটি ফরজ ইবাদতের সওয়াব ৭০টি ফরজ আদায়ের সমান করে বান্দার আমলনামায় লিখে দেওয়া হয়।
আগাম প্রস্তুতি : মুমিনের ইবাদত হবে সার্বক্ষণিক। সে সবসময় আল্লাহর রহমতের দিকে তাকিয়ে থাকবে। উত্তম সময়গুলোকে বেশি করে কাজে লাগাবে। আল্লাহ তায়ালা তার বিশেষ অনুগ্রহে বান্দাকে এমন কিছু সময় উপহার দিয়েছেন, যার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বান্দা সম্মানের উচ্চ মাকামে পৌঁছে যেতে পারে। তেমনি একটি মাস রমজান। ইবাদতে পূর্ণতা লাভে বান্দার এক অনন্য সুযোগ। অন্যান্য মাসে ইবাদত তো করবই তেমনি এই মাসটির বিশেষ মর্যাদাকে নিজের জীবনে অবশ্যই কাজে লাগাব। তাই রমজান আসার আগেই এ মাসের কল্যাণ হাসিলের মানসিকতায় নিজেকে বলীয়ান করব। বেশি বেশি দোয়া, দুরুদ, তাওবা-ইস্তেগফার ও ইসলামী জীবনযাপনের মাধ্যমে রোজার শিক্ষাকে নিজের জীবনে ধারণ করব। আর মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। বলতে থাকব, হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও। তোমার অনুগ্রহ না পেলে আমরা তো জাহান্নামি হয়ে যাব। কেউ আমাদের ওই কঠিন আজাব থেকে বাঁচাতে পারবে না। একমাত্র তুমিই পারো, আমাদের পাপ রাশিকে মুছে দিয়ে তোমার আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দিতে। এভাবে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করুন। মন নরম হয়ে যাবে। ইবাদতে শান্তি পাবেন। অন্যায় থেকে ফিরে আসবেন। চাইলেও শয়তান আপনাকে দিয়ে আর পাপ কাজ করাতে পারবে না। কারণ আপনি আল্লাহর হয়ে গেছেন। আর যে আল্লাহর হয়ে যায় তার ক্ষতি করার সাধ্য কারো নেই।
মানসিক শক্তি বৃদ্ধি : রমজান মাসের ফজিলত হাসিলের জন্য নিজের মনের অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। আমলের খাতায় উত্তম আমলগুলো একের পর এক যোগ করতে হবে। আমলগুলো আল্লাহর কাছে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যেখানে নিয়তে কোনো গড়বড় থাকবে না। উদ্দেশ্য একটাই, আল্লাহকে রাজি-খুশি। তাই এখনি সংকল্প করুন, নিজের জীবনটাকে আল্লাহর বিধানের বাইরে নিয়ে যাবেন না। তবে আপনার রমজান আপনার জন্য অমর শিক্ষা রেখে যাবে। আল্লাহর দেওয়া ঘোষণা আপনার জন্য পূর্ণ করা হবে। রমজান চলে যাবার পরেও এই অনুশীলন আপনি ভুলে যাবেন না। রমজান মাসে আপনার গুনাহ মাফের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকবে ঠিকই, এ ক্ষেত্রে আপনি সফলও হবেন, অন্য দিকে রমজান আপনাকে পূর্ণ ইমানের অধিকারী সাচ্চা মুসলিম বানিয়ে দেবে। কাজে আপনার সততা থাকবে। হারামের ধারেকাছেও যাবেন না। এমনকি আল্লাহর বিধানের লঙ্ঘনও করবেন না। আপনার মহব্বত থাকবে সত্য ও সুন্দরের প্রতি। পুণ্যের দিকে। এই মানসিক অবস্থায় যখন আপনি চলে যাবেন, আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবেন না। আল্লাহর অসীম দয়ায় আপনার নাজাতও মিলে যাবে।
ক্ষমার অতৃপ্ত বাসনা : আল্লাহর রহমত কে না চায়? জানবেন, তিনি ছাড়া মানুষকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা অন্য কারো নেই। হয়তো এই সূক্ষ্ম কথা আপনি বুঝতে পারছেন না। আপনার চাওয়া আল্লাহর বিধানের অনুরূপ হয়নি বিধায় তিনি আপনার মনের ইচ্ছেকে পূরণ করছেন না। তাই বলে, ভেঙে পড়া, নিরাশ হওয়া যাবে না। মনে রাখবেন, আল্লাহ অবশ্যই সেই ক্ষমতা রাখেন, যিনি অতীতের ঘাটতি ও বর্তমানের পূর্ণতার সমন্বয়ে বান্দাকে অগণিত দান করতে পারেন। রমজানকে সামনে রেখে মনের চাওয়াকে আরো প্রশস্ত করতে হবে। এর সাথে তৈরি থাকবে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা-ভক্তি ও উত্তম আমলের সুন্দর মানসিকতা। তাই আপনার ইবাদতগুলোকে আল্লাহর সামনে এমনভাবে পেশ করতে হবে, যে ইবাদতে কোনো ধরনের শিরক থাকবে না। নিজের অন্তর হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকবে। তাহলে রোজা অবশ্যই নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে।
বেশি বেশি দোয়া-প্রার্থনা : রমজান আসার আগে থেকেই নিজেকে গুছিয়ে নিন। ধরে নেবেন, এটাই আপনার জীবনের শেষ রমজান। তাই আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ থাকবে, হে আল্লাহ, তুমি আমাকে এই রমজানের ফজিলত হাসিলের তওফিক দাও। কারণ তোমার রহমত না থাকলে এই রমজান আমার জন্য কিছুই রেখে যেতে পারবে না। তাই তোমার করুণায় রহমত দিয়ে আমাকে ভরিয়ে দাও। বেশি বেশি নেক আমল করার সুযোগ দাও। আমার ইবাদতগুলো যেন এমন হয় যে ইবাদত হবে তোমারই দাসত্ব।

Leave a Comment